ঋণের বেড়াজালে তৃণমূল নারী : তাহাদের দুঃখগাথা

২৫ নভে, ২০০৮ ·

বিশ্বব্যাপী যখন ৰুদ্র ঋণ প্রকল্পকে মডেল হিসেবে নেয়া হচ্ছে তখন বাংলাদেশে ৰুদ্র ঋণ গ্রহীতাদের মধ্যে অনেকে নিজের উন্নয়ন তো দূরের কথা সহায়-সম্বল হারিয়ে পথের ভিখারি পর্যনত্দ হচ্ছেন। অনেকে কিসত্দির টাকা পরিশোধ করতে না পেরে এনজিও কর্মীদের ধিক্কার ও হুমকির কারণে আত্মহত্যা করছেন। এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। অধিকাংশ এনজিও বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলো শুধু তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের ৰুদ্র ঋণ প্রদান করে। যেসব নারীদের ঋণ প্রদান করা হয় তাদের আগে থেকে আয় বর্ধকমূলক কাজের ওপর কোনো প্রশিৰণ থাকে না। এনজিও কর্মীরা তো তাদের টার্গেট পূরণ করতে পারলেই বেতন পাবেন। তাই তারা যাচাই ছাড়া যাকে তাকে ঋণ প্রদান করে থাকেন।

অধিকাংশ ঋণ গ্রহীতা নারীরা ঋণ নিয়ে তাদের স্বামীর হাতে তুলে দেন। দেখা গেছে স্বামী কোনো ৰুদ্র ব্যবসায় বিনিয়োগ না করে টাকা ইচ্ছানুযায়ী খরচ করে ফেলেন। ফলে কিসত্দির দায় এসে পড়ে নারীর ঘাড়ে। কিসত্দির টাকা না দিতে পারলে নারীকে লাঞ্ছনা-গঞ্জনা দেয় এনজিও কর্মীরা। এমনও দেখা গেছে অপমান সহ্য করতে না পেরে অনেক নারী আত্মহত্যা করেন। অনেকে পরিবার আবার কিসত্দির টাকা পরিশোধ করতে বসতভিটা পর্যনত্দ বিক্রি করেন। অথচ এনজিওগুলোর ঋণ নীতিমালায় রয়েছে এক এনজিওর সদস্য অন্য এনজিওর সদস্য হতে পারবে না। কিন্তু এনজিও কর্মীরা তাদের ঊধর্্বতন কতর্ৃপৰের চোখে ধুলো দিয়ে নিজের চাকরি টিকানোর জন্য সেই নীতিমালাকে অগ্রাহ্য করেন।
মোসা. মুনা বিবি (৩৭) একজন গৃহিণী। স্বামী বর্গাচাষি। দুই মেয়ে ও দুই ছেলে নিয়ে সংসার। পরের জমি চাষাবাদ করে মোটামুটি সংসার চলত। গ্রামীণ ব্যাংক কার্যক্রম শুরম্ন করার পর প্রথমে ঋণ নেয়। কিন্তু এক সময় ব্যাঙের ছাতার মতো এলাকায় গড়ে ওঠে বিভিন্ন এনজিও। ওসব এনজিও কর্মীরা ঋণ প্রদানের লৰ্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন। মুনা বিবি প্রায় ৭টি এনজিও থেকে ৰুদ্র ঋণ নেন। স্বামীর একমাত্র সম্বল দুটি হালের গরম্ন। হঠাৎ একটি হালের গরম্ন মারা যায়। এতে স্বামীও বেকার হয়ে যায়। কারণ হাল কিনে বর্গা চাষ করে কোনো লাভ হয় না। জোতদারেরা সব ফসল নিয়ে যায়। তাদের এখন প্রায় দেড় লাখ টাকা দেনা হয়েছে।
এমেলি বেগম (৩৫) চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার প্রত্যনত্দ অঞ্চলে স্বামী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে নিয়ে বসবাস করেন। স্বামী দিনমজুর। এক সময় এমেলি বেগম অন্যান্য নারীদের মতো প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংক পরে আশা, প্রশিকা, ব্র্যাকসহ কয়েকটি স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নেন। এতে স্বাবলম্বী হওয়া তো দূরের কথা ঋণের দায়ে শেষ পর্যনত্দ যুব উন্নয়ন অধিদফতর কতর্ৃক দায়ের করা মামলায় জেলহাজতে যেতে হয়। তিনি জানান, এনজিওগুলো শুধু ঋণ দিয়ে কিসত্দি আদায়ের জন্য আসে। কিন্তু ঋণের টাকা নিয়ে কী করা যায় এই বিষয়ে কেউ পরামর্শ দেয় না। ঋণ নিয়ে এখন ফেঁসে গেছি। জানি না কবে দেনামুক্ত হতে পারব।
সুখী বেগমের (৪৫) তিন মেয়ে ও চার ছেলে নিয়ে সংসার। স্বামী একজন ৰুদ্র ব্যবসায়ী। গ্রামীণ ব্যাংক, আশা, প্রশিকা, ঠেঙ্গামারা সবুজ সংঘসহ কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে তিনি স্বামীকে ব্যবসা করতে দেন। ব্যবসায় বড় ধরনের লোকসান হলে ভিটামাটি পর্যনত্দ বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করতে পারেননি। এক সময় ঋণের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার লৰ্যে অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলেদের বিয়ে দিয়ে যৌতুকের টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে বাধ্য হন। তিনি জানান, ঋণ প্রদানের সময় গ্রম্নপ তৈরির জন্য এনজিও কর্মীরা বাড়িতে ধরনা দেয়। কিসত্দি আদায়ের সময় অমানবিক আচরণও করে। তবে মাঠকর্মীদের কোনো দোষ নেই। কারণ তারা চাকরি বাঁচাতে এই অশোভন ব্যবহার করে থাকে।
ৰুদ্র ঋণের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নারীদের স্বাবলম্বী তথা আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার নাম করে অনেক এনজিও ব্যবসা চালাচ্ছে। তারা বাংলাদেশ ব্যাংক কতর্ৃক নিয়ম-কানুনকে অমান্য করলেও তাদের বিরম্নদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। অধিকাংশ স্থানীয় এনজিও প্রতিষ্ঠানের রেজিস্ট্রেশন পর্যনত্দ নেই। সুদের হারও অনেক বেশি। প্রতিটি এনজিওদের নীতিমালায় উলেস্নখ রয়েছে, একজন নারী একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানের সদস্য হলে অন্য এনজিওতে তাকে সদস্য হিসেবে নেয়া যাবে না। কিন্তু মাঠকর্মীদের ম্যানেজাররা অন্য এনজিওদের সদস্যদেরও সদস্য করার টার্গেট দেন। এতে মাঠকর্মীরা চাকরি বাঁচানোর জন্য নিয়মনীতি অমান্য করেন। এতে যে নারীর ঋণ প্রয়োজন নেই তাকেও ঋণ নিতে আগ্রহী দেখায়। এ ছাড়াও তৃণমূল পর্যায়ের নারীরা অশিৰিত ও অদৰ। নেই কোনো প্রশিৰণ, নেই ব্যবসার মতো উপযুক্ত পরিবেশ। জানে না কী কাজে ব্যবহার করতে হবে ঋণের টাকা। শেষ পর্যনত্দ ঋণের সব দায় এসে পড়ে নারীর ওপর। এভাবে অনেকের সংসারও ভাঙে।


মাঠকর্মীদের বক্তব্য


শফিকুল আলম (ছদ্মনাম) রম্নরাল রি-কন্সট্রাকশন ফাউন্ডেশন (আরএমএফ) নামক একটি এনজিওতে কর্মরত। এই মাঠকর্মী বলেন, কিসত্দির টাকা আদায় করতে খুবই কষ্ট হয়। বৃষ্টি-বাদলের সময় ঋণ গ্রহীতারা কিসত্দি দিতে পারে না। অফিসের বসদের চাপের কারণে আমরা অভদ্রোচিত আচরণ করতে বাধ্য হই। কিসত্দি আদায় করতে না পারলে বেতন থেকে কেটে নেয়। অনেক সময় সদস্যরা মোবাইল, টিভি, কাঁথাসহ যাবতীয় আসবাবপত্র পর্যনত্দ পানির দরে বিক্রি করেন।


ব্র্যাক ও বাইস নামের এনজিওতে কর্মরত সাবেক এক মাঠকর্মী ফারম্নক জানান, ব্র্যাকে কাজ করতে গিয়ে মানুষের ঘরের টিন বিক্রি করে কিসত্দি আদায় করেছি। বাইস এনজিওতেও একই সমস্যা। ফলে রাগ করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে মুদি দোকান দিয়েছি। যাদের কোনো গতি নেই তারা ৰুদ্র ঋণ প্রকল্পে চাকরি করে।

এই ব্লগে..

বাংলাদেশ: মানুষ, প্রেম, স্বাধীনতা, রাজনীতি, দারিদ্রতা আর সম্ভাবনার দেশ। সে দেশের কিছু বিষয়...মনের গভীরে আকি-বুকি কাটা ঘটনা আর অবসরের হাবিজাবি নিয়ে আমার এই ব্লগ।

যেকোন বিষয় নিয়ে মেইল করতে পারেন: bdidol@জিমেইল.কম

সাম্প্রতিক পোষ্ট

সামহ্যোয়ার ব্লগ পোষ্ট